অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস হলো এক ধরণের ওষুধ যা মূলত বিষণ্ণতা (depression) রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, উদ্বেগজনিত ব্যাধি (anxiety disorders), অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD), পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যথাসহ অন্যান্য কিছু মানসিক ও শারীরিক অবস্থার চিকিৎসায় এগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।
যদিও অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস কীভাবে কাজ করে তার সঠিক প্রক্রিয়া এখনও সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়নি, তবে মনে করা হয় যে এগুলো মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে। এই রাসায়নিক পদার্থগুলোকে নিউরোট্রান্সমিটার (neurotransmitters) বলা হয়, যা স্নায়ু কোষের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন (serotonin), নরএপিনেফ্রিন (norepinephrine) এবং ডোপামিন (dopamine)-এর মতো কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা কম থাকতে দেখা যায়। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস এই নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বিভিন্ন উপায়ে নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। কিছু ওষুধ নিউরোট্রান্সমিটারের পুনঃশোষণ (reuptake) প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়, যার ফলে স্নায়ু কোষের মধ্যে তাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আবার কিছু ওষুধ নিউরোট্রান্সমিটারের উৎপাদন বৃদ্ধি করে বা তাদের রিসেপ্টরগুলোর সংবেদনশীলতাকে পরিবর্তন করে।
বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস রয়েছে, প্রত্যেকটির নিজস্ব কার্যকারিতার প্রক্রিয়া এবং সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। প্রধান প্রকারগুলো হলো:
- সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটরস (SSRIs): এগুলো মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের পুনঃশোষণকে বিশেষভাবে বাধা দেয়, যার ফলে সেরোটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। SSRI গুলো সাধারণত অন্যান্য অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টসের তুলনায় কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং প্রথম সারির চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণ: ফ্লুওক্সেটিন (Fluoxetine), সেরট্রালিন (Sertraline), প্যারোক্সেটিন (Paroxetine), সিটালোপ্রাম (Citalopram), এসসিটালোপ্রাম (Escitalopram), ফ্লুভোক্সামিন (Fluvoxamine)।
- সেরোটোনিন-নরএপিনেফ্রিন রিআপটেক ইনহিবিটরস (SNRIs): এগুলো সেরোটোনিন এবং নরএপিনেফ্রিন উভয়েরই পুনঃশোষণকে বাধা দেয়, ফলে মস্তিষ্কে এই দুটি নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রাই বৃদ্ধি পায়। SNRI গুলো কিছু ক্ষেত্রে SSRI-এর চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ: ভেনলাফ্যাক্সিন (Venlafaxine), ডুলোক্সেটিন (Duloxetine), ডেসভেনলাফ্যাক্সিন (Desvenlafaxine), লেভোমিলনাসিপ্রান (Levomilnacipran)।
- ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস (TCAs): এগুলো পুরনো ধরণের অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট এবং সেরোটোনিন ও নরএপিনেফ্রিন উভয়ের পুনঃশোষণকে বাধা দেয়। তবে, এদের কিছু উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, তাই বর্তমানে এগুলো সাধারণত প্রথম সারির চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয় না, যদি না অন্যান্য ওষুধ কার্যকর না হয়। উদাহরণ: অ্যামিট্রিপটাইলিন (Amitriptyline), নরট্রিপটাইলিন (Nortriptyline), ইমিপ্রামিন (Imipramine), ডক্সেপিন (Doxepin), ক্লোমিপ্রামিন (Clomipramine)।
- মনোঅ্যামিন অক্সিডেজ ইনহিবিটরস (MAOIs): এগুলো মস্তিষ্কে মনোঅ্যামিন অক্সিডেজ নামক এনজাইমের কার্যকারিতা বন্ধ করে দেয়, যা সেরোটোনিন, নরএপিনেফ্রিন এবং ডোপামিনকে ভেঙে ফেলে। এর ফলে এই নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। MAOI গুলোর গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং খাদ্য ও অন্যান্য ওষুধের সাথেInteractions থাকতে পারে, তাই এগুলো সাধারণত অন্যান্য চিকিৎসা ব্যর্থ হলে শেষ অবলম্বন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ: ট্র্যানিলসাইপ্রোমিন (Tranylcypromine), ফেনেলজিন (Phenelzine), আইসোকারবক্সাজাইড (Isocarboxazid), সেলেগিলিন (Selegiline) (ত্বকের প্যাচ হিসেবে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে)।
- অ্যাটিপিক্যাল অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস (Atypical Antidepressants): এই শ্রেণীর অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টগুলো অন্যান্য শ্রেণীর মতো স্পষ্টভাবে কাজ করে না এবং এদের কার্যকারিতার প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণ:
- বুপ্রোপিওন (Bupropion): এটি ডোপামিন এবং নরএপিনেফ্রিনের পুনঃশোষণকে বাধা দেয় এবং সাধারণত যৌন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম সৃষ্টি করে।
- মিরটাজাপিন (Mirtazapine): এটি সেরোটোনিন এবং নরএপিনেফ্রিনের নিঃসরণ বৃদ্ধি করে এবং ঘুমের উন্নতি ঘটাতে পারে।
- ট্রাজোডোন (Trazodone): এটি সেরোটোনিনের পুনঃশোষণকে দুর্বলভাবে বাধা দেয় এবং প্রধানত ঘুমের সমস্যার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ভর্টিওক্সেটিন (Vortioxetine): এটি সেরোটোনিনের পুনঃশোষণকে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য সেরোটোনিন রিসেপ্টরের উপরও কাজ করে।
- ভিলাজোডোন (Vilazodone): এটি সেরোটোনিনের পুনঃশোষণকে বাধা দেয় এবং একটি নির্দিষ্ট সেরোটোনিন রিসেপ্টরের আংশিক অ্যাগোনিস্ট হিসেবেও কাজ করে।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস মূলত নিম্নলিখিত অবস্থার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়:
- Major Depressive Disorder (MDD): বিষণ্ণতার প্রধান চিকিৎসা এটি।
- Anxiety Disorders: যেমন জেনারেলাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (GAD), প্যানিক ডিসঅর্ডার, সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার।
- Obsessive-Compulsive Disorder (OCD): SSRI এবং ক্লোমিপ্রামিন এক্ষেত্রে কার্যকর।
- Post-Traumatic Stress Disorder (PTSD): SSRI এবং SNRI ব্যবহার করা হয়।
- Chronic Pain: কিছু TCA এবং SNRI দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ু ব্যথা (neuropathic pain) এবং ফাইব্রোমিয়ালজিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- Bulimia Nervosa: ফ্লুওক্সেটিন এই রোগের চিকিৎসায় অনুমোদিত।
- Bedwetting (Nocturnal Enuresis): শিশুদের ক্ষেত্রে TCA (যেমন ইমিপ্রামিন) কখনও কখনও ব্যবহার করা হয় যখন অন্যান্য চিকিৎসা ব্যর্থ হয়।
- Migraine Prevention: কিছু TCA মাইগ্রেন প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যক্তিভেদে এবং ওষুধের প্রকারভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো:
- SSRIs এবং SNRIs: বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথা ব্যাথা, মাথা ঘোরা, অনিদ্রা বা তন্দ্রাচ্ছন্নতা, যৌন সমস্যা (যেমন কম লিবিডো, অর্গাজমে সমস্যা), ক্ষুধামান্দ্য বা বৃদ্ধি, ওজন পরিবর্তন, অতিরিক্ত ঘাম, অস্থিরতা বা উদ্বেগ।
- TCAs: মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ঝাপসা দৃষ্টি, কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রস্রাব করতে অসুবিধা, মাথা ঘোরা, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, হৃদস্পন্দনের পরিবর্তন, ওজন বৃদ্ধি।
- MAOIs: মাথা ঘোরা, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, অনিদ্রা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তচাপের পরিবর্তন, খাদ্য ও অন্যান্য ওষুধের সাথে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া (যেমন টাইরামিন সমৃদ্ধ খাবার)।
- অ্যাটিপিক্যাল অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস: এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ওষুধের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। বুপ্রোপিওনের ক্ষেত্রে উত্তেজনা, অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য দেখা যেতে পারে। মিরটাজাপিনের ক্ষেত্রে তন্দ্রাচ্ছন্নতা এবং ওজন বৃদ্ধি হতে পারে। ট্রাজোডোনের ক্ষেত্রে তন্দ্রাচ্ছন্নতা এবং মাথা ঘোরা দেখা যায়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
- অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সেবন শুরু করার পর কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে এর সম্পূর্ণ প্রভাব অনুভব করতে। ধৈর্য ধরে ওষুধ চালিয়ে যাওয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা জরুরি।
- হঠাৎ করে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বন্ধ করা উচিত নয়। ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে ডোজ কমানো প্রয়োজন, অন্যথায় withdrawal symptoms দেখা দিতে পারে।
- অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সেবনকালে কোনো অস্বাভাবিক বা গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তারকে জানানো উচিত।
- কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সেবনকালে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। তাই চিকিৎসা শুরুর প্রথম কয়েক সপ্তাহে রোগীর উপর বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন।
- অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট শুধুমাত্র রোগের লক্ষণ উপশম করে, রোগের মূল কারণের চিকিৎসা নয়। মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারের সাথে নিয়মিত থেরাপি (যেমন কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি - CBT) গ্রহণ করা বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে সহায়ক হতে পারে।
আপনার নির্দিষ্ট অবস্থার জন্য কোন অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সবচেয়ে উপযুক্ত এবং এর সঠিক ডোজ ও ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জানার জন্য একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।
Antidepressants এর উদাহরণ: